বিলুপ্ত প্রাচীন ঐতিহ্য কাঠের খরম-পাদুকা |
এখন শুধুই ইতিহাস
একখন্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে খড়ম তৈরি করা হয়। সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেয়া হয় যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলটি দিয়ে আঁকড়ে ধরা হয়। বর্তমানে পা আটকে রাখার জন্য কাঠের গুটির পরিবর্তে রাবার খন্ড ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন কালে খড়মের উদ্ভব। খড়ম পায়ে হাঁটা সহজ নয়। এছাড়াও খড়ম পায়ে হাঁটার সময় চটাশ্ চটাশ্ বেশ শব্দ হয়। আমাদের দেশে এক সময় খড়ম ছিল একমাত্র সম্বল। রাতে শোবার আগে পুকুর থেকে পা ধুয়ে আসতে হবে। ওজু করে ঘাট থেকে মসজিদে যেতে হবে। দরকার খড়ম। পাদুকা বলতেই ছিল কাঠের তৈরি খড়ম। গড়ে উঠেছিল খড়ম শিল্প। প্রধানত দু রকম খড়ম ছিল প্রচলিত। খুঁটিওয়ালা বা বৈলা খড়ম- হাইহিলের আদিরূপ বলা যায়। আর ছিল ফিতাওয়ালা চটির মতো খড়ম।
ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে কাঠের পাদুকা বা খড়ম। বাংলাদেশেও এক সময় খড়মের প্রচলন ছিল। জমিদার ও স্থানীয় ভূ-স্বামীরা পরতেন খড়ম। এখন এই ধরণের পাদুকা নেই বললেই চলে। তবে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কিছু সাধু-সন্ন্যাসী। এখনো তাদের অনেকের পায়ে খড়ম শোভা পায়।
পৃথিবীর প্রাচীনতম খড়ম পাওয়া গিয়েছিল ভারতের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে প্রাচীনতম এই খড়ম পাওয়া গিয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৮০০০ বছর আগে। বর্তমানে চামড়া কিংবা ফোম জুতো তৈরির কাজে ব্যবহৃত হলেও অতীতে এই দুই উপকরণ মোটেই সহজলভ্য ছিল না। বরং কাঠের প্রাচুর্য ছিল গোটা বিশ্বেই। স্বাভাবিকভাবেই কাঠই বেছে নেওয়া হয় জুতো তৈরির প্রধানতম উপকরণ হিসেবে।
খড়ম একপ্রকার কাঠের পাদুকা। হিন্দি "খড়ৌঙ" শব্দটি থেকে বাংলায় "খড়ম" শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃতে খড়ম "পাদুকা" নামে পরিচিত। হিন্দুধর্মে খড়মের ব্যবহার সুপ্রচলিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে খড়ম দেবতা ও শ্রদ্ধেয় সাধুসন্তদের পদচিহ্নের প্রতীক।হিন্দুধর্মের পাশাপাশি জৈনধর্মেও সন্ন্যাসী ও সাধুসন্তেরা খড়ম ব্যবহার করে থাকেন। মহাকাব্য রামায়ণে খড়মের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।বাংলাদেশের লোকজ ছড়াটিতে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে:হরম বিবি খড়ম পায়খটটাইয়া হাঁইটা যায়হাঁটতে গিয়া হরম বিবিধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়আছাড় খাইয়া হরম বিবিফিরা ফিরা পিছন চায় ....
কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরবিশেবান্ধব। তারপরও মানুষ খড়মকে পরিহার করছে। অপরদিকে বার্মিজ জুতা মানুষের মাথা গরম করা, পায়ের নিচের স্তর চামড়া মোটা করে বয়রা নামক রোগের সৃষ্টি করে।
একটি কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম তৈরি করতে (মজুরি ও কাঠের দাম বাবদ) বর্তমান বাজারে খরচ পড়ে ২শ টাকা।
আমাদের দেশে তপোবন ও আশ্রমবাসী ঋষি সন্ন্যাসীরা নাকি এ খড়ম ব্যবহার করতেন। প্রাচীন রূপকথা, লোকসাহিত্য ও প্রবাদ- প্রবচনে পাদুকার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাম বনবাসে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ভাই লক্ষণ। অপর ভাই ভরত রামের পাদুকা (খড়ম) সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করেছিলেন। এতে মনে হয় যে, সুদূর অতীতেও খড়মের প্রচলন ছিল। শুধু আমাদের দেশে নয় অন্যান্য দেশেও খড়ম ছিল। এর একটি প্রমাণ সিলেটে রক্ষিত হযরত শাহজালাল (রহ.) এর খড়ম।
দরবেশ শাহজালাল (রহ.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীসাথীসহ সিলেটে আসেন। তিনি ইয়ামান, তাবরেজ, কুনিয়া দিল্লি হয়ে আসেন সিলেটে। সিলেটের দরগা মহল্লায় মুফতি নাজমুদ্দিন আহমদের পারিবারিক তত্ত্বাবধানে তাঁর খড়ম ও তলোয়ার আছে বলে লোক মুখে প্রচলিত আছে। অনুমান করা যায় ওই সময় বাংলার বাইরেও খড়ম ছিল।
পঞ্চাশ এমনকি ষাটের দশকেও গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খড়ম ছিল। ষাটের দশকে ‘স্পঞ্জ’ নামে ফোম, রাবার, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল আসতে থাকে। তবে ‘চটি’ এর আগেও ছিল। ব্যবহার ছিল অভিজাত শ্রেণিতে। দামও ছিল বেশি। স্পঞ্জ প্রথম দিকে একচ্ছত্র বাজার পেয়েছিল। এখন প্লাস্টিক ও চামড়ার উন্নতমান ও রকমারি ডিজাইনের জুতা ও স্যান্ডেলের জয়জয়কার।
খড়ম হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো দোকানে কদাচিৎ দেখা যায়। গ্রামে কদাচিৎ খড়ম দেখা যায়। আশির দশকেও বাংলাদেশে অনেকেই ব্যবহার করতেন কাঠের পাদুকা বা খড়ম। এখন তেমন আর ব্যবহার হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন।
তথ্যসূত্র :
0 Yorumlar